সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্রেফতার রথী-মহারথীরা নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত। ডিবি পুলিশের রিমান্ডে তারা দিচ্ছেন চাঞ্চল্যকর নানা তথ্যও।
বেশি জেরার মুখে আছেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান।
তারা ডিবিকে জানিয়েছেন, আন্দোলনের শেষের দিকে ছাত্রদের পক্ষে কথা বলায় পলককে গণভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর চাপের কারণেই টেন মিনিট স্কুলের সঙ্গে ৫০০ কোটি টাকার চুক্তি বাতিল করা হয়। টুকু জানান, মন্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। শুধু প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। সালমান এফ রহমান বলেন, এর আগে আমি ২ বছর জেল খেটেছি। সুতরাং আমার কোনো সমস্য হবে না। তবে আমাকে জেলে রাখা হলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর জিয়াউল আহসান বলেন, আমার ওপর বিশেষ দায়িত্ব ছিল। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে সবার মোবাইল ফোনকল রেকর্ড করা হয়নি। নির্দিষ্ট কিছু লোকের ফোনকল রেকর্ড করা হয়। কারও হোয়াটসঅ্যাপস কল রেকর্ড করা হয়নি। ভয় দেখানোর জন্য এটা ছড়ানো হয়েছে যে, হোয়াটসঅ্যাপ রেকর্ড করা হচ্ছে।
সাবেক ডেপুটি স্পিকার টুকুকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনারা কেন টাকার বিনিময়ে পুলিশ নিয়োগ দিলেন? জবাবে বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে পুলিশে নিয়োগের বিষয়টি আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম।’ তখন টুকুকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়, ‘আপনি যখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তখন অপনার ভাই এবং আপনার ছেলে সরাসরি টাকা নিয়েছেন। অন্য একজন ব্যক্তির কাছ থেকে আপনি নিজে সরাসরি টাকা নিয়েছেন।’ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি সব সময় আল্লাহর কাছে চেয়েছি, আমি যেন সংসদে যেতে পারি। আমার বয়স যখন ২৫ বছর তখন থেকেই এটা চাচ্ছিলাম। কিন্তু ৬০ বছর বয়সে আল্লাহ কবুল করেছেন। আমি মন্ত্রিত্ব চাইনি। জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীকে হারানোর কারণে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা নিজেই আমাকে মন্ত্রী হওয়ার অফার করেন।
প্রথমে আমাকে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী করা হয়। এর ৬ মাস পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়া হলে আমি ওই দায়িত্ব নিতে চাইনি। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বাংলার ছাত্রী হয়ে পুরো দেশ চালাচ্ছি। আর তুমি ম্যানেজমেন্টের ছাত্র হয়ে একটি মন্ত্রণালয় চালাতে পারবে না? তুমি দায়িত্ব নাও। সমস্যা হলে আমাকে বলবে। আমি সব সমস্যার সমাধান দেব।
সালমান এফ রহমান ডিবিকে বলেন, আন্দোলনের সময় আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছি, দেশের মানুষ আমাদের ওপর খেপে যাচ্ছেন। তিনি পাত্তা দেননি। ছাত্র অন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শেখ হাসিনা আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘পুলিশ এতো ভালো কাজ করছে। সেনাবাহিনী কেন পারছে না। এ সময় আমি বিষয়টি নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেই।
সালমান এফ রহমানকে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, ‘মামলা তো মাত্র শুরু। কতগুলো মামলা হবে তা আমরাও জানি না। আপনাকে শুধু আদালতে যেতে হবে আর ডিবিতে আসতে হবে। এ সময় সালমান এফ রহমান বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২ বছর জেল খেটেছি। সুতরাং সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, আমাকে জেলে রাখলে দেশের ক্ষতি হবে। কারণ আমার নানা প্রতিষ্ঠানে অনেক কর্মী আছে। তারা বেতন পাবে না। ব্যাংক থেকে যেসব টাকা ঋণ নিয়েছি সেগুলো পরিশোধ হবে না। তখন ডিবি কর্মকর্তা হেসে বলেন, ‘আপনারা ১৫ বছরে দেশটি খেয়ে ফেলেছেন। আর এখন আপনাকে ছেড়ে দেব-সেটা ভাবার কারণ নেই।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রশ্ন করা হয়, আপনি তো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বানিয়েছেন, এতে লাভ কী হয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বানাইনি। এটা তো তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।’
এ সময় ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘যে মন্ত্রণালয়ই আইন তৈরি করুক না কেন সেটা ভেটিংয়ের জন্য তো অবশ্যই আইন মন্ত্রণালয়ে গেছে। তখন আপনি ভূমিকা নিলেন না কেন? উপরন্তু বিতর্কিত আইনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। আর ওই আইনের মাধ্যমে অনেক সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তাকে হয়রানি-নির্যাতন করা হয়েছে।
এ সময় চুপ হয়ে যান সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ডিবির এক প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি তো মেনে নিয়েছিলাম। তারা যে এত দ্রুত সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে যাবে তা বুঝতে পারিনি। তখন ডিবি কর্মকর্তা বলেন, কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করে আনার একটি বদভ্যাস আপনাদের আছে। সে কারণেই আজ এই অবস্থা। তাকে প্রশ্ন করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপনারা কেন বাতিল করলেন? জবাবে আনিসুল হক বলেন, আদালত স্বাধীন। এ সংক্রান্ত রায় আদালত থেকে এসেছে। সরকার শুধু বাস্তবায়ন করেছে।
এ সময় তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালত তো বলেছিলেন, সরকার চাইলে আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখতে পারে। আপনারা কেন সেটা রাখলেন না? ২০১৮ সালে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়, তখন ছাত্ররা সব কোটা বাতিল চায়নি। তারা সংস্কার চেয়েছে। কিন্তু আপনারা কোটা বাতিল করে দিলেন কেন? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, এসব হয়েছে শুধু প্রধানমন্ত্রীর রাগ এবং একগুঁয়েমির কারণে। ডিবি কর্মকর্তার প্রশ্ন ছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী যেহেতু রাগ করে কোটা বাতিল করেছেন, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। এটা দেখিয়েই তো আপনি আইনমন্ত্রী হিসাবে পদত্যাগ করতে পারতেন?
এ সময় আনিসুল হক বলেন, ‘শেখ হাসিনার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আপনারা যেমন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মানতে বাধ্য, আমরা তেমন শেখ হাসিনার আদেশ মানতে বাধ্য ছিলাম।’ তখন ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতনের অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য না। আর অন্যায় আদেশ মানিনি বলেই দীর্ঘদিন পদোন্নতি হয়নি। পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল খারাপ জায়গায়। আপনারাও তো অন্যায় আদেশ না মানার দৃষ্টান্ত দেখাতে পারতেন।
ডিবি হেফাজতে রিমান্ডে থাকা আসামি সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সরকার পতনের একদফা অন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ৪ আগস্ট গণভবনে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছি, প্রয়োজনে আমাকে বলি দিন। তারপর শিক্ষার্থীদের অন্দোলন বন্ধ করুন। তাদের চোখের ভাষা, মনের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন। এ সময় সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমাকে তেড়ে মারতে আসেন। তখন আমি সাহসী হয়ে গেলাম। প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি স্টেপ ডাউন করুন।
আওয়ামী লীগকে মানুষ ঘৃণা করছে, থুতু দিচ্ছে। এরপর আমাকে গণভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। পলক ডিবিকে জানান, স্মার্ট বাংলাদেশে গঠনে টেন মিনিট স্কুলের সঙ্গে ৫ বছর মেয়াদি সরকারের যে ৫০০ কোটি টাকার চুক্তি ছিল সেটা আমি বাতিল করতে চাইনি। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জোর করে ওই চুক্তি বাতিল করায়।
কারণ, ওই স্কুলের অন্যতম কর্ণধার আইমান সাদিক অন্দোলনকারী ছাত্রদের পক্ষে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তারা তাদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছিলেন। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে পলক বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বাস্তবতা মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানালেও তিনি মানতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ সময় সংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তা তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি সত্যিই দেশের স্থিতিশীলতা চাইতেন তাহলে দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন না কেন?’ তখন চুপ থাকেন পলক।
গ্রেফতাররা জানিয়েছেন, দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পেছনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই দায়ী। কারণ তিনি আমাদের কারও কথা শুনতেন না। এ সময় ডিবি কর্মকর্তা পালটা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘আপনারা যারা উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও নেতা ছিলেন তারা শেখ হাসিনাকে বোঝাতে পারেননি। আপনারা যদি সবাই শেখ হাসিনাকে সঠিক বার্তা দিতেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতেন। তারপরও আপনাদের কথা না শুনলে আপনারা কয়েকজন পদত্যাগ করতেন।’
এ সময় তারা ডিবি কর্মকর্তাদের বলেন, ‘আপনারা জানেন না শেখ হাসিনা কত বড় একরোখা মানুষ।’ তখন ডিবির প্রশ্ন-‘আপনারা নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। নিজেদের বিবেকের কাছ কী দায় এড়াতে পারবেন? এ সময় তারা না-সূচক জবাব দেন।
রিমান্ডে থাকা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে ডিবির প্রশ্ন ছিল, ‘২০১৩ সালে আপানি র্যাবের ইন্টেলিজেন্স শাখার প্রধান ছিলেন তখন শাপলা চত্বরে এতগুলো মানুষ মারার প্রয়োজন কী ছিল?
জবাবে বলেন, ‘তৎকালীন আইজি, র্যাব ডিজি এবং পুলিশ কমিশনার আমাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি চেষ্টা করেছি, যে কোনো মূল্যে শাপলা চত্বর ফাঁকা করার। আমরা ফাঁকা গুলি করেছি। তবে সেখানে কোনো লোক মারা যায়নি।
লোক না মারা যায় তাহলে নারায়ণগঞ্জে লাশ পাওয়া গেলে কেন? ডিবির এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, সেগুলো নারায়ণগঞ্জে মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বলেন, ওই ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই এমদাদ জড়িত। ‘সেভেন মার্ডারের পর সেখানে আরও দুটি খুন হয়েছে। ওই দুটি খুন আপনি নিজে করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ‘কী বলেন? আমি এসবের কিছুই জানি না। প্রধানমন্ত্রীকে আমি বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে সতর্ক করেছি।
‘আয়নাঘর’ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ওটা আমার বিষয় না। গ্রেফতারের আগে ৮ দিন আমাকেও সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় রাখা হয়। এর কারণ হলো-আয়নাঘরের কারিগরদের কাছে যেসব সরঞ্জামাদি ছিল এনটিএমপি প্রতিষ্ঠার পরপর সেগুলো কিছু আমি নিয়ে আসি। এ কারণে তারা আমার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। মানুষের কল রেকর্ডের বিষয়ে জিয়াউল আহসান বলেন, সবার মোবাইল ফোন রেকর্ড করা হয়নি। তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে কেন গুম করেছেন? ফার্মগেট থেকে জাতীয় পার্টির এক নেতাকে তুলে এনে কেন হত্যা করছেন?
ইলিয়াস আলীর বিষয়ে জিয়ার কাছে সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন ছিল, ‘ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার পর তিনি আপনাকে ফোনে বলেছিলেন, ইলিয়াসকে ছেড়ে দাও। আপনি ওই সময় বলেন, ‘ইলিয়াস আলীকে কিছুক্ষণ আগে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’ এ সময় জিয়া কোনো মন্তব্য করেননি।