নওগাঁর বদলগাছীতে আনন্দমার্গ শিক্ষা, ত্রাণ ও জনকল্যাণ ট্রাস্টের জমিতে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। উপজেলার আধাইপুর ইউনিয়নের সাদিশপুর গ্রামে চলছে এই গৃহ নির্মাণের কাজ।
হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে ঘর নির্মাণ করছে উপজেলা প্রশাসন। এদিকে, ঘর নির্মাণ কাজ বন্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর ট্রাস্টের সভাপতি আবেদন করলেও অজ্ঞাত কারণে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৪ সালে উপজেলার সাদিশপুর গ্রামের শিক্ষানুরাগী শ্রী প্রভাস চন্দ্র দাস আনন্দমার্গ শিক্ষা, ত্রাণ ও জনকল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পৈত্রিক ১৭.২৬ একর জমি এই ট্রাস্টের নামে দানও করেছেন। ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৬ জন শিক্ষক ৭৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া ট্রাস্টের অর্থায়নে প্রতি শুক্রবার একজন চিকিৎসক এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন এবং ঐ প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৩য় পর্যায়ে উপজেলায় মোট ৪৬ টি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ আসে। এর মধ্যে সাদিশপুর মৌজার জে,এল নং-১৫০ হাল ১১৫, এস,এ খতিয়ান নং-২২, আর.এস খতিয়ান নং ৪৪, সাবেক দাগ নং-১১২, হাল দাগ নং-১৭৯ ভিটা ০.৬০ একর অংশে ০.৩০ একর সম্পত্তিতে ১১টি ঘর এবং একই খতিয়ানভূক্ত সাবেক দাগ ১৮৩ ও ৩০৬ নং হাল দাগে ভিটা ০. ৬৬ একর অংশে ০.৩৩ একরে ২টি ঘর ও আর,এস ৪৫ নং খতিয়ানের সাবেক দাগ ১৮৬, হাল ৩২০ নং দাগে ভিটা ০.৫২ একর অংশে ০.৫২ একর সম্পত্তিতে ১৫ টি ঘর নির্মাণ কাজ চলছে। ২৮টি ঘর ঐ ট্রাস্টের জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। মোট জমির পরিমাণ ১ একর ১৫ শতাংশ। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন এসব ঘর নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। বিষয়টি জানার পর ট্রাস্টের সভাপতি সুশীল চন্দ্র মন্ডল গত ৬ জানুয়ারি ইউএনও’র কাছে ট্রাস্টের জমিতে ঘর নির্মাণের কাজ বন্ধের জন্য আবেদন করলে ইউএনও আলপনা ইয়াসমিন প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রসহ তাদেরকে তাঁর কার্যালয়ে আসতে বলেন। পরে ট্রাস্টের সভাপতি এবং কমিটির অন্য সদস্যরা যাবতীয় কাগজ পত্রসহ ইউএনও’র সঙ্গে দেখা করেন। ইউএনও কাগজপত্র দেখে ডিসির আদেশে জমিগুলো খাস হয়েছে বলে জানান তাদের। এছাড়া ডিসির আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের আদেশ না আনা পর্যন্ত ঘর নির্মাণ চলবে বলেও জানান তিনি।
ওই ট্রাস্ট ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাদিশপুর, উত্রাসন ও চকমোহনপুর মৌজার ১৭.২৬ একর জমির মূল মালিক শ্রী কৃঞ্চ কুমার দাস। তার দুই ছেলে শ্রী গিরিশ চন্দ্র দাস ও জ্যোতীশ চন্দ্র দাস। জ্যোতীশ চন্দ্র দাসের দুই ছেলে শ্রী মনিন্দ্র নাথ দাস ও শ্রী ফনিন্দ্র নাথ দাস। তারা ১৯৭১ সালে ভারতে গিয়ে আর দেশে ফিরেন নি। ১৯৮৩ সালে জ্যোতীশ চন্দ্রের মৃত্যুর পর গিরিশ চন্দ্র দাস পৈত্রিক শরীক সূত্রে উক্ত জমির মালিক হন। গিরিশ চন্দ্রের মৃত্যুর পর তার ছেলে শ্রী ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস পৈত্রিক শরীক সূত্রে জমির মালিক হন। ১৯৭৪ সালে শত্রæ (এনিমি) সম্পত্তি আইন বিলুপ্ত সত্তে¡ও মো. আব্দুল জব্বারসহ কতিপয় ব্যক্তি ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা যোগসাজস করে উক্ত সম্পত্তি শত্রæ (এনিমি) সম্পত্তি ঘোষণা করে এক সনা লীজ নেয়। পরে ১৯৮৪ সালে শ্রী ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস নওগাঁ সদর মুনসেফ আদালতে নালিশি সম্পত্তিতে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মোকর্দ্দমা করেন। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন বদলগাছী উপজেলা সহকারী জজ আদালত দুতরফা শুনানী শেষে সাক্ষ্য প্রমাণ পর্যালোচনা করে নালিশী সম্পত্তিতে বাদীর স্বত্ব ও নিরঙ্কুশ দখল আছে বলে রায় দেন। অত:পর মোঃ আব্দুল জোব্বার গং ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ১৯৯১ সালে সহকারী জজ আদালত নওগাঁতে সরকারকে বাদী করে বাটোয়ারা মামলা করেন। ২০০৯ সালে সহকারী জজ আদালত নওগাঁ সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে মামলাটি খারিজ করে দেন। পরে মোঃ আব্দুল জোব্বার গং এ রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ কোর্টে আপিল করে। ২০১১ সালে যুগ্ম জেলা জজ কোর্ট-১ নওগাঁ উক্ত আপিল মামলাটি দোতরফা শুনানী শেষে তা না মঞ্জুর করে দেয়। কিন্তু বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা জজ জ্যোতীশ চন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর তদীয় ৩, ৪ নং বিবাদী জীবিত আছে। ফলে ছেলের বর্তমানে ভ্রাতুষ্পুত্রের পুত্র ১নং বিবাদী কখনই হিন্দু আইনের বিধান মতে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইতে পারে না। ফলে উক্ত সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯২ ধারা মোতাবেক সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে। এ রায়ের ফলে জেলা প্রশাসক নওগাঁ উক্ত সম্পত্তি খাস হিসেবে রেকর্ড করার আদেশ দেন।
যুগ্ম জেলা জজের বিতর্কিত রায় ও জেলা প্রশাসকের আদেশের বিরুদ্ধে শ্রী প্রভাশ চন্দ্র দাস হাইকোর্টে সিভিল রিভিউশন ৪০৪৪ অফ ২০১১ দায়ের করলে ২০১১ সালে হাইকোর্ট উক্ত বিতর্কিত মন্তব্য ও জেলা প্রশাসকের আদেশের বিরুদ্ধে রুল জারি করে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। পরে ২০১৩ সালে রুলের নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত বিতর্কিত মন্তব্য ও জেলা প্রশাসকের আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন।
ট্রাস্টের সভাপতি শ্রী সুশীল চন্দ্র মন্ডল বলেন, ট্রাস্টের জমির আয় থেকে বহুমুখী সেবামূলক কাজ করা হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি এতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় ও একটি ধ্যান মন্দির স্থাপন করে ধর্মীয় ও সেবামূলক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আইনের বিধান মতে ২৩ মার্চ ১৯৭৪ তারিখে শত্রæ সম্পত্তি আইন বিলুপ্ত হওয়া সত্তে¡ও কিছু কুচক্রীমহল ভূমি অফিসের অসাধু ব্যক্তির যোগসাজসে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষনা করে লীজ গ্রহণ করলে সরকারের বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ হয়। পুনরায় সরকার এই সম্পত্তিতে বাটোয়ারা মামলা করলে সহকারী জজ আদালতে মামলা খারিজ হয়। এরপর জেলা যুগ্ম জজ আদালতের এক বিতর্কিত মন্তব্যকে অবলম্বন করে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে এই সম্পত্তি খাস করণের নির্দেশ হলে মহামান্য হাইকোর্ট উক্ত জেলা প্রশাসকের নির্দেশ ও বিতর্কিত মন্তব্যের উপর রুল ইস্যূ করেন এবং রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা স্থগিত করেন। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে শুনানীর জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টের উক্ত স্থগিতাদেশ অমান্য করে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ধর্মীয় ও জনকল্যাণ ট্রাস্টের সাদিশপুর মৌজার তিনটি দাগে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ট্রাস্টের জমিতে নির্মাণ কাজ বন্ধের জন্য গত ৯ ফেব্রæয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করলেও আজ পর্যন্ত কাজ বন্ধ হয় নি। সরকার ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করছে সেটা একটি মহৎ উদ্যোগ। তবে তা কোনোভাবেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমিতে হতে পারে না।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, জমি যাচাই-বাছাই এবং জমি নির্বাচন করার দায়িত্ব ইউএনও’র আমার নয়। আমি ঘর বাস্তবায়ন করছি।
হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আনন্দমার্গ শিক্ষা, ত্রাণ ও জনকল্যাণ ট্রাস্ট এর নামীয় জমিতে দুর্যোগ সহনীয় গৃহ নির্মাণ কাজ করা বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন জানান, জমিগুলো খাস, তাই সেই জমিতে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারদের পুনর্বাসন করার জন্য ২৮টি গৃহ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, জমিগুলোতে আনন্দমার্গ শিক্ষা, ত্রাণ ও জনকল্যাণ ট্রাষ্ট নেই। তারা জাল দলিল তৈরি করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জমি বলে দাবি করছে।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান পিএএ জানান, বিষয়টি জরুরী দেখা হবে।